চতুর্থ শিল্পবিপ্লবঃ আগামী প্রজন্মের জন্য চ্যালেঞ্জ।
[vc_row][vc_column width=”1/4″][vc_single_image image=”847″ img_size=”300×400″ alignment=”center”][/vc_column][vc_column width=”3/4″][vc_column_text]
লেখাটি
প্রফেসর ডক্টর শামীম আহাম্মেদ,
কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ।
স্যার এর ফেইসবুক হতে সংগৃহীত
[/vc_column_text][/vc_column][vc_column][vc_separator color=”blue” border_width=”3″][/vc_column][/vc_row][vc_row][vc_column][vc_column_text]
হাতে চায়ের কাপ নিয়ে, ইন্টারনেটের দুনিয়ায় ঘুরতে ফিরতে হঠাৎ করেই চোখে পড়ল, ২৯শে জুন, ২০২৩ তারিখে FirstPost-এ প্রকাশিত একটি রিপোর্টের উপর, বিশ্ববিখ্যাত হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয় নাকি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা AI-রোবটকে অধ্যাপনার কাজে নিয়োগ দিতে চলেছে! আমার তো চক্ষু চড়কগাছ! তাড়াতাড়ি হিসাব-নিকাষ করে দেখলাম, আমার অধ্যাপনার চাকুরীর আর যে কয়দিন বাকী আছে, অন্ততঃ এরমধ্যে আমাদের দেশে AI-রোবট-প্রফেসরের আসার সম্ভাবনা একদমই ক্ষীণ! যাক বাবা বাঁচা গেল, এই যাত্রা অন্ততঃ “অন্নে-বস্ত্রে” মরব না! কিন্তু মাথায় মধ্যে একটা দুষ্ট বুদ্ধি খেলে গেল! ধরা যাক, AI-প্রফেসর সাহেবরা একসময় আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধ্যাপনার কাজ শুরু করলেন, যদি হার্ভাডের AI-প্রফেসরের “প্রোগ্রাম” আর আমাদের দেশের AI-প্রফেসরের “প্রোগ্রাম” একই ভার্সনের (Version) হয়, তাহলে তো সেইসব AI-প্রফেসরের দক্ষতাও একই মানের হবে, ফলে আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের স্বাদ কিছুটা হলেও পাবে, বেশ ভালোই ব্যাপার! এই পর্যন্ত চিন্তাভাবনার মধ্যে কোনো ধরণের “দুষ্টমি’ নাই! “দুষ্টমি”র যে চিন্তাটা আমাকে নাড়া দিল, তা হচ্ছে, আচ্ছা, পদ-পদবীর জন্য “আগ্রহী” AI-প্রফেসরদেরকে কি অতিরিক্ত কোনো AI-প্রোগ্রাম মডিউল দেওয়া হবে! আচ্ছা দেওয়া হলো, ধরে নিলাম, কিন্তু “আগ্রহী” AI-প্রফেসরদের এই অতিরিক্ত AI-প্রোগ্রাম মডিউলগুলোর ভার্সনও যদি একই হয়, তাহলেই তো সমস্যার শুরু! একই ভার্সনের AI-প্রফেসরদের মধ্যে, দলের দাসত্ব প্রমাণের জন্য চাটুকারিতার প্রতিযোগিতা কীভাবে হবে! এইটা ভেবে মনে বেশ হাসি পেল! তবে সেই হাসি বেশিক্ষণ থাকল না, চোখ গিয়ে পড়ল আরেকটি রিপোর্টের উপর, ১৬ই জুলাই, ২০২৩ তারিখে Hindustan Times-এ বলা হয়েছে, ভারতে AI-রোবট টেলিভিশনে সংবাদ উপস্থাপিকা হিসাবে কাজ শুরু করতে চলেছে! আবার চিন্তিত হয়ে পড়লাম! আমার দুশ্চিন্তার মাত্রা আরও বৃদ্ধি পেল যখন দেখলাম, গত ১৯ তারিখে বাংলাদেশের বেসরকারি টেলিভিশন, চ্যানেল ২৪-এ একজন AI-সংবাদ উপস্থাপিকা হাজির হয়েছে! ভারি বিপদ হলো তো! আমার এক শ্যালিকা আমাদের দেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশনে সংবাদ পাঠিকার কাজ করে, AI- সংবাদ উপস্থাপিকা এইভাবে আবির্ভুত হলে, আমার শ্যালিকার ভবিষ্যৎ কী হবে! কী যে মুশকিল হলো, দুশ্চিন্তা দেখি আমার পিছু ছাড়ছেই না! AI-কেন্দ্রিক চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের বিপদ দেখছি কাউকে না কাউকে আঁকড়ে ধরছেই! মনোযোগ দিয়ে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের আগমণ বার্তা পড়তে শুরু করলাম, আমার কপালের চিন্তার ভাঁজ ধীরে ধীরে আরও বড় হতে শুরু করল, না জানি, আমাদের জন্য সামনে কী ভয়াবহ চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে!
মানব সভ্যতার ইতিহাসে শিল্পবিপ্লবের ধারাগুলো যদি আমরা একটু পর্যবেক্ষণ করি, তাহলে দেখতে পাব, আঠারো শতকে বাষ্পীয় ইঞ্জিন দিয়ে প্রথম শিল্পবিপ্লবের যাত্রা শুরু হয়েছিল, এরপরে ১৮৭০ থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লবের মূখ্য ভুমিকায় ছিল তথ্য-যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রাথমিক প্রযুক্তির আবির্ভাব, ভবন-ব্রিজ ইত্যাদিতে স্ট্রাকচারাল বা কাঠামোগত ডিজাইনে সাফল্য, শিল্প-উৎপাদনে সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। ১৯৭০ সালের পরে তৃতীয় শিল্পবিপ্লবে, মানব সভ্যতা সিলিকন চিপ, ইন্টারনেট ও আধুনিক তথ্য-যোগাযোগ ব্যবস্থার মতো উন্নত প্রযুক্তির ছোঁয়ায় নিজেদের জীবন-যাত্রাকে বদলে দেয়, কিন্তু এই পর্যন্ত প্রযুক্তির উদ্ভাবন, প্রয়োগ ও নিয়ন্ত্রণ মানুষের হাতেই ছিল, সবচেয়ে বড় কথা বিশ্বজনীন ছিল। মনে হচ্ছে সমস্যা শুরু হবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব থেকে, যেখানে, রোবটিক্স, আইওটি এবং অটোমেশনসহ সর্বত্রই AI-প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে, নতুন নতুন কোনো প্রযুক্তির উদ্ভাবন থেকে শুরু করে সেই প্রযুক্তির প্রয়োগ ও নিয়ন্ত্রণে মানুষের ভুমিকা একসময় নগণ্য হয়ে যেতে পারে!
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এখনও সূচনালগ্নে রয়েছে, এর বিস্তার কালভেদে একেক দেশে একেকভাবে হবে, তবে এই চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের বিকাশ তার চূড়ান্ত ধাপে উন্নীত হতে কতো সময় নিবে, তা এখন বলা মুশকিল! দশ বছর, নাকি পঞ্চাশ বছর, নাকি একশত বছর, তা জানি না। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সূচনাপর্বে, এর সুফল মানুষকে আকৃষ্ট করবে, অনেক ক্ষেত্রে জীবনযাত্রা অনেক অনেক সহজ হবে, নির্বোধ যন্ত্রের “কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা” বা AI-কে মানুষ উপভোগ করবে, দেখে আনন্দ পাবে! চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বিকাশের এই প্রাথমিক পর্যায়ে, অনেক অনেক উদ্যোগ বিশ্বের একটা উল্লেখযোগ্য জনগোষ্টীকে, পরিবর্তিত AI-প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য উচ্চতর শিক্ষা দিয়ে, প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে গড়ে তুলবে। তবে আমার ধারণা, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বিকাশের সাথে সাথে, একটা পর্যায়ে, যন্ত্রের “কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা” আর উপভোগ্য থাকবে না, তখন এর সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারার সক্ষমতা অর্জন করা, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে! আমার আশংকা, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ব্যাপ্তি যত বেশি প্রসারিত হবে, সাধারণ মানুষের অস্তিত্ব ততটাই হুমকির মুখে পড়বে! একসময়, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব চূড়ান্ত ধাপে উন্নীত হওয়ার পরে, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বের মূল সংকটগুলো তৈরি হবে।
টেলিভিশনের AI-নিউজ প্রেজেন্টার আহামরি ধরণের কোনো AI প্রোগ্রাম নয়, তাছাড়াও স্বস্তির জায়গা হচ্ছে, AI-নিউজ প্রেজেন্টারের প্রোগ্রামটি একজন মানুষ লিখেছেন, একজন মানুষ যেভাবে প্রোগ্রামটি লিখেছেন, AI-নিউজ প্রেজেন্টার ঠিক সেইভাবেই কথা বলবে, অঙ্গভঙ্গি করবে! শুধু তাই নয়, AI-প্রোগ্রামের মধ্যে দিয়ে আইয়ুব বাচ্চু কিংবা মান্না দে’র লাইভ গানও আবার আমাদের মাঝে ফিরে আসতে পারে! আরও আছে, AI-সমৃদ্ধ VR-এর (Virtual Reality) প্রোগ্রামগুলো আমাদের মস্তিস্কে সুন্দরবন ভ্রমণের “সত্যিকারের মতো” অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারবে, গানের সিডি পাল্টে দেওয়ার মতো AI-প্রোগ্রাম পরিবর্তন করলে, আমাজন জঙ্গলে ভ্রমণ কিংবা গভীর সমুদ্র ভ্রমণেরও অনুভূতি আমাদের মস্তিস্কে সৃষ্টি করতে পারবে! AI-সমৃদ্ধ VR প্রোগ্রামগুলো আসলে আমাদের মস্তিস্কে প্রায় সকল ধরণের আমোদ-প্রমোদ-আনন্দ-উত্তেজনা বা অন্য “যেকোন চাহিদার” “সত্যিকারের মতো” অনূভুতি সৃষ্টি করতে পারবে। তাহলে প্রশ্ন চলেই আসে, AI-সমৃদ্ধ সেই VR জগতে, রক্ত-মাংসের শিল্পী-অভিনেতা-অভিনেত্রীর অস্তিত্ব শেষ পর্যন্ত কোথায় থাকবে? খুবই জটিল একটা প্রশ্ন! তারপরেও একটা ভালো দিক, ঐ পর্যন্ত অন্ততঃ রক্ত-মাংসের “মানুষের” দরকার পড়বে, ঐসব AI-প্রোগ্রামগুলো লেখার জন্য! কিন্তু মানব সভ্যতার জন্য সবচেয়ে ভয়ংকর AI-প্রোগ্রাম হচ্ছে, এমন একটা AI-প্রোগ্রাম যা মানুষের সাহায্য ছাড়াই নিজে নিজেই যেকোনো প্রোগ্রাম লিখতে পারে, গুগলের AI-প্রোগ্রাম “আলফাকোড” মানব জাতির জন্য সেই ধরণের একটি অশনি সংকেত!
শব্দটা যেহেতু “শিল্পবিপ্লব”, অর্থাৎ, শিল্প-উৎপাদন-পুঁজি-শ্রম-মুনাফা শব্দগুলো এখানে জড়িত, সুতরাং, এই আলোচনায় রাজনৈতিক-অর্থনীতির বিষয়টা স্বাভাবিকভাবেই চলে আসবে। অনেকে মানব সমাজকে ধর্মের ভিত্তিতে, বিশ্বাসের ভিত্তিতে, বর্ণের ভিত্তিতে, সংস্কৃতির ভিত্তিতে, ভৌগলিক সীমানার ভিত্তিতে বিভিন্ন জাতি-গোত্রে ভাগ করেছেন; আবার কেউ কেউ সরাসরি দুইটা ভাগে ভাগ করেছেন, শাসক শ্রেণি এবং শাসিত শ্রেণি, আমার কাছে এই দ্বিতীয় শ্রেণিবিন্যাসকে সার্বজনীন বলে মনে হয়েছে; কেননা সকল ধর্মের-বর্ণের-সংস্কৃতির শাসক শ্রেণির জীবন-যাপন, স্বভাব-চরিত্র, চাহিদা, ভোগ-বিলাস প্রায় একই রকম; আবার অন্যদিকে, সকল ধর্মের-বর্ণের-সংস্কৃতির শাসিত শ্রেণির জীবন-যাপন, বঞ্চনা-শোষণ-দুঃখ-কষ্ট প্রায় একই প্রকৃতির। এই শাসক শ্রেণি বলতে বোঝানো হচ্ছে, উৎপাদন ব্যবস্থায় যাঁরা পূঁজির যোগান দিবেন আর উৎপাদন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করবেন, অবশ্য যেসব দেশে “লুটেরা অর্থনীতির মডেল” চালু রয়েছে, সেইসব দেশের আমলা-নেতা-পুলিশকেও এই শাসক শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচনা করা যায়, কারণ তাঁরাও পরোক্ষভাবে পূঁজির যোগান দেন বা উৎপাদন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে ভুমিকা রাখেন! অন্যদিকে, শাসিত শ্রেণি হচ্ছে উৎপাদন ব্যবস্থায় যারা শ্রমের যোগান দিবেন আর শ্রমের যোগান দেওয়ার প্রয়োজনে বেঁচে থাকবেন! এই শ্রম শুধুমাত্র শারীরিক শ্রম নয়, মেধার শ্রমও হতে পারে। আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (IMF) মার্চ, ২০২২ সালে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে উল্লেখ করেছে, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মধ্যে, সম্পদের বিচারে, শীর্ষস্থানীয় ১০% ধনী জনগোষ্ঠীর হাতে বিশ্বের মোট আয়ের ৫২% থাকে, আর নিচের দিক থেকে ৫০% দরিদ্র জনগোষ্ঠীর হাতে থাকে বিশ্বের মোট আয়ের ৮.৫%, মধ্যবিত্ত বাকী ৪০% জনগোষ্ঠীর হাতে আছে বাকী অংশ। এই শীর্ষস্থানীয় ১০% শ্রেণিই হচ্ছে শাসিত শ্রেণি, যাঁরা বিশ্বের প্রায় সকল ক্ষমতা, অর্থ ও নীতিনির্ধারণ নিয়ন্ত্রণ করেন! সমস্যা আরও গুরুতর। আর্থিকভাবে অধিকতর সচ্ছল জনগোষ্ঠী উন্নত শিক্ষার সুযোগ পাবে, ফলে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে পরিবর্তিত উচ্চতর প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে তাঁরা তাঁদের দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগ পাবে, এরফলে তাঁদের আয়ও বৃদ্ধি পাবে, এই প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি ঘটবে, ফলে ধনী জনগোষ্ঠী আরও বেশি ধনী হবে, তাঁদের হাতে সার্বিক নিয়ত্রণ আরও বৃদ্ধি পাবে। অন্যদিকে আর্থিকভাবে অসচ্ছল জনগোষ্ঠি উন্নত শিক্ষার সুযোগ পাবে না, ফলে পরিবর্তিত প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে চলার মতো দক্ষতা তাঁরা অর্জন করতে পারবে না, ফলশ্রুতিতে তাঁরা চাকুরী হারাবে কিংবা তাঁদের আয় হ্রাস পাবে, এই প্রক্রিয়ারও পুনরাবৃত্তি ঘটবে এবং দরিদ্র শ্রেণি আরও বেশি দরিদ্র হবে। এইভাবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এই দুই শ্রেণির মধ্যে আয় বৈষম্য বৃদ্ধি করবে, কোনোভাবেই হ্রাস করবে না। জানুয়ারী, ২০২০ সালে, IntechOpen থেকে প্রকাশিত Industrial Robotics-New Paradigm নামের বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, উৎপাদনে মোট আয়ের বিবেচনায়, যাঁদের আয় মোট আয়ের ১০ শতাংশের কম, সেই জনগোষ্ঠী চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের আটোমেশন বা স্বয়ংক্রিয়করণের কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে পতিত হবে! আর অন্যদিকে, যাঁদের আয় মোট আয়ের ৭৫ শতাংশের উপরে, সেই জনগোষ্ঠীর ঝুঁকি সবচেয়ে কম হবে। সুতরাং, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রভাব এই শাসক ও শাসিত শ্রেণির উপর যে আলাদা আলাদা হবে, সে কথা বলাই বাহুল্য। বিচ্ছিন্নভাবে কেউ কেউ শাসিত শ্রেণির অধিকার ও অস্তিত্বের পক্ষে আওয়াজ তুলছেন বটে, কিন্তু শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সেই আওয়াজ আসলেই ক্ষীণ!
শ্রেণি বৈষম্যের এই অবস্থা আসলে শেষ অবস্থা নয়, শুরু মাত্র! উৎপাদন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য যাঁরা নতুন উদ্যোক্তা হতে ইচ্ছুক, তাঁরাও বিশ্বজুড়ে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছেন এবং পড়বেন, বড় বড় মাছগুলো যেমন ছোটো ছোটো মাছগুলোকে গিলে খেয়ে ফেলে! আমাদের দেশেও, যেসব ছোটো ছোটো নতুন আইটি কোম্পানীগুলো ভালো করছিল, তাদের অনেকগুলোকেই বড় বড় কোপানীগুলো কিনে ফেলেছে! তাদেরকে আবার বিশ্বের আরও বড় বড় মাছ খেয়ে ফেলছে! যেমন, বড় বড় টেক জায়ান্টের কথাই যদি বলি, গুগল ২০০৫ সালে YouTube, ২০০৭ সালে Fitbit, ২০১২ সালে Motorola Mobility-এর মতো বড় বড় কোম্পানীগুলোকে কিনে নিয়েছে; আবার, মাইক্রোসফট ২০১৬ সালে LinkedIn, ২০১১ সালে Skype, ২০১৮ সালে GitHub, ২০২২ সালে Activision Blizzard-এর মতো বড় বড় কোম্পানীগুলোকে কিনে নিয়েছে বা ভদ্র ভাষায় “আত্তীকরণ” করেছে! বিশ্বজুড়ে আইটি জগতের নিয়ন্ত্রণ যেন গুটিকয়েক জানান্ট কোম্পানীগুলোর হাতে চলে যাচ্ছে। চতুর্থ শিল্পবিব্লব যেহেতু AI কিংবা আইটি কেন্দ্রিক হবে, সুতরাং বলা যেতেই পারে, আগামী বিশ্বে কারা হবেন মেধা-শ্রমের শাসক শ্রেণি আর কারা হবেন মেধা-শ্রমের শাসিত শ্রেণি, আর এই দুই শ্রেণির মধ্যে আয়-বৈষম্য-বা কী ধরণের হবে! আরও বেশি আশংকার জায়গাটা হচ্ছে, সেই সময়ের “সকল ধরণের” শাসক শ্রেণির AI-নির্ভর স্বয়ংক্রিয় উৎপাদন ব্যবস্থায় কিংবা তাঁদের ভোগ-বিলাসী জীবন- যাপনের জন্য সর্বত্রই যেখানে AI-রোবটের ছড়াছড়ি, সেখানে বিলিয়ন বিলিয়ন “শারীরিক শক্তি সর্বস্ব” শাসিত শ্রেণির প্রয়োজন আদৌ থাকবে কী না? এই প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই লুকিয়ে আছে, “শারীরিক শক্তি সর্বস্ব” শাসিত শ্রেণির অস্তিত্বের সংকট আদৌ তৈরি হবে, নাকি হবে না!
Industrial Robotics-New Paradigm-এ আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তখ্য প্রদান করা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কারণে স্বয়ং আমেরিকাতেই ৪৭% চাকুরী হুমকির মুখে পড়বে, ইউরোপে এই সংখ্যা ৪৫% থেকে ৬০%-এর মধ্যে। এখানে দেখানো হয়েছে, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব যেহেতু রুটিন কাজগুলোকে স্বয়ংক্রিয়করণ করবে, ফলে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কারণে, বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষিত মানুষদের মধ্যে যাঁদের চাকুরী ঝুঁকির মধ্যে পড়বে, তাঁদের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা (বা এর নিচে শিক্ষায়) শিক্ষিত মানুষ, নিম্ন-মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষিত মানুষ ও উচ্চ-মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষিত মানুষের চাকুরী হারানোর ঝুঁকি যথাক্রমে ৫২%, ৪০% এবং ১৮%। একমাত্র উচ্চশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের নিরাপত্তা কিছুটা আছে, যদিও প্রশ্ন থেকেই যায়, স্বয়ংক্রিয়করণের কারণে আসলে কতজন উচ্চ শিক্ষিত মানুষের চাহিদা শেষ পর্যন্ত থাকবে?
IntechOpen-এর রিপোর্টে বলা হয়েছে, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে স্বয়ংক্রিয়করণের কারণে ২০৩৭ সালা নাগাদ বিভিন্ন খাতের চাকুরী ঝুঁকির মধ্যে পড়বে, এরমধ্যে যোগাযোগ খাতে ৫০%, শিল্প-উৎপাদন খাতে ৪২%, আর্থিক ও বীমা খাতে ৩০%, স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক সেবা খাতে ১৯% এবং শিক্ষাখাতে ৮%। তারমানে, আগামী প্রজন্মের মধ্যে যারা শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক সেবাকে পেশা হিসাবে চিন্তা করবে, তাদের কর্মসংস্থানের ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম। আমাদের দেশের মোট রফতানীর মধ্যে ৮০% ভাগের বেশি হচ্ছে রেডিমেট গার্মেন্টস পণ্য। এই শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকের সংখ্যা ৩৫ লক্ষের উপরে, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে স্বয়ংক্রিয়করণের কারণে, শুধুমাত্র গার্মেন্টস শিল্প-উৎপাদন সংশ্লিষ্ট ৩৫ লক্ষ মানুষ যদি জীবিকা হারায়, তাহলে আমাদের দেশের কী অবস্থা হবে! বাংলাদেশের প্রায় এককোটি নাগরিক বিদেশে কর্মরত আছেন, অথচ, আগষ্ট, ২০১৬ সালে, ADB Briefs-এর একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ২০১৪ সালে বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকদের মধ্যে দক্ষ শ্রমিকের সংখ্যা মাত্র ৩৪%। ফলে যেসব দেশে আমাদের নাগরিকরা কর্মরত আছেন, সেসব দেশে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের স্বয়ংক্রিয়করণের কারণে, তাঁদের চাকুরীচ্যুতি ঘটলে এবং তাঁরা দেশে ফিরে আসলে, আমাদের দেশের কী অবস্থা হবে!
১৭ই এপ্রিল, ২০২৩ তারিখে, The Business Standard-এর একটি রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, আমাদের দেশে ২০১৭ সালে কৃষিকার্যে মোট কর্মসংস্থান ৪০.৬% থেকে ২০২২ সালে ৪৫.৪%-এ বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু জিডিপিতে কৃষিখাতের অবদান একই সময়ে ১৩.৬% থেকে ১১.৭%-এ হ্রাস পেয়েছে। অন্যদিকে, জিডিপিতে শিল্প-কারখানার অবদান ২০১৭ সালের তুলনায় ২০২২ সালে ৩২.৭% থেকে ৩৫.৩%-এ বৃদ্ধি পেয়েছে, অথচ, সেখানে কর্মসংস্থানের হার, একই সময়ে ২০.৪% থেকে ১৭%-এ হ্রাস পেয়েছে, একেবারেই বিপরীত চিত্র! এর অর্থ, শিল্প-কারখানার আধুনিকায়নের ফলে মুনাফা বৃদ্ধি পাচ্ছে বটে কিন্তু শিল্প-উৎপাদন খাতে “শারীরিক শ্রমের” শ্রমিক কম দরকার পড়ছে! ধীরে ধীরে কৃষিকার্যেও উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে বা পাচ্ছে, শুধু তাই নয়, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে ভবিষ্যতে অনেক কৃষি পণ্য কৃত্রিমভাবে উৎপাদিত হবে, যেমন, জুন ২৩, ২০২৩ সালে, CNN-এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অচিরেই মানুষ, মুরগীর কোষ থেকে ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা কৃত্রিম মুরগীর মাংস বাণিজ্যিকভাবে পেতে যাচ্ছে, সুতরাং, ভবিষ্যতে কৃষিখাতেও “শারীরিক শ্রমের” কর্মসংস্থান সাংঘাতিকভাবে সংকুচিত হবে! ফলে, আমরা অনুমান করতেই পারি, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের আবির্ভাব আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থানে কী ধরণের প্রভাব ফেলতে পারে।
বাংলাদেশে জনশক্তি আছে, কিন্তু চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চাহিদা শুধুমাত্র জনশক্তি নয়, চাই “উন্নত প্রযুক্তিতে দক্ষ” জনশক্তি এবং উপযুক্ত পরিবেশ, যেখানে আমাদের দেশ এখনও অনেক পিছনের দিকে আছে। এই দেশের সার্টিফিকেটধারী গ্র্যাজুয়েটদের বেশিরভাগই “দক্ষ জনশক্তির” সংজ্ঞার অনেক বাহিরে। ২০২২ সালে, Network Readiness Index (NRI)-এ বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে গড়ে ৮৮তম; আলাদা আলাদা ভাবে, প্রযুক্তিতে ৮১ তম, জনগণের অবস্থাম ৯২তম, শাসন ব্যবস্থার অবস্থান ১০১তম । বিগত দশকে আমাদের দেশে তথ্য-প্রযুক্তিতে অনেক উন্নতি হয়েছে, কোনো সন্দেহ নাই, কিন্তু সমস্যা হছে, আমাদেরকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে টিকে থাকতে হবে, তাই তথ্য-প্রযুক্তিতে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমাদের অবস্থানের উপর নির্ভর করবে, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রতিযোগিতার যুগে, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমাদের অস্তিত্ব কেমন হবে!
কোনোই সন্দেহ নাই, AI-এর নতুন নতুন প্রযুক্তি সাধারণ মানুষের জন্য অস্তিত্বের সংকট তৈরি করবে, বিশেষ করে “শারীরিক শক্তি সর্বস্ব” মানুষের অস্তিত্বের জন্য এক ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করবে। AI-এর বুদ্ধিমত্তার সাথে টিকে থাকতে হলে, AI-এর বুদ্ধিমত্তাকে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার কাজে কীভাবে ব্যবহার কয়া যায়, উচ্চশিক্ষত জনগোষ্ঠী সেই চেষ্টা করতে পারে। ব্যাপারটা অনেকটা “মাছের তেলে মাছ ভাজা”র মতো! এই বিষয়ে অনেকগুলো উদাহরণ দেওয়া যায়, আমি দুয়েকটা উল্লেখ করছি। মার্চ ২১, ২০২৩ তারিখে Entrepreneur-এ প্রকাশিত একটি নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে, জনৈক জ্যাকসন, AI-চ্যাট-জিপিটিকে (ChatGPT) জিজ্ঞেস করেছিলেন, একশত ডলার বিনিয়োগ করে কীভাবে একটি ব্যবস্যা শুরু যেতে পারে। চ্যাট-জিপিটির সাথে জ্যাকসনের ধারাবাহিক কথোপকথনের একপর্যায়ে AI-চ্যাট-বট (Chatbot) জ্যাকসনকে “গ্রীন গ্যাজেট গুরু” (Green Gadget Guru) খোলা যেতে পারে বলে মতামত দেয়, যেখানে আরও নির্মল জীবন যাপনের জন্য মানুষকে পরিবেশবান্ধব পণ্য ও তথ্যসেবা প্রদান করা হবে। শুধু মতামত দিয়েই চ্যাট-বট দায়িত্ব শেষ করে নাই, প্রাথমিক পূঁজি একশত ডলার কীভাবে এবং কোন কোন খাতে বিনিয়োগ করতে হবে, সে ব্যাপারেও AI-চ্যাট-বট গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ প্রদান করে, সেই পরামর্শ অনুসরণ করে পনেরো ডলার দিয়ে ওয়েবসাইটের ডোমেইন ক্রয় করা হয়, উনত্রিশ ডলার দিয়ে ওয়েবসাইট হোস্টিং করা হয়, এখানে ওয়েবসাইট ও লোগো তৈরিতেও AI-চ্যাট-বটের সক্রিয় সাহায্য গ্রহণ করা হয়। AI-চ্যাট-বটের পরামর্শে, ফেসবুক ও ইস্ট্রগ্রামে ওয়েবসাইটের প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় এবং সেখানে বিজ্ঞাপনের জন্য চল্লিশ ডলার ব্যায় করা হয়। সবশেষে AI-চ্যাট-বটের পরামর্শে, সার্চ ইঞ্জিনে ওয়েবসাইটির প্রাপ্যতা সহজলভ্য করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এরপর জ্যাকসন দাবী করেন, প্রথম দিনেই তাঁর উপার্জন পাঁচশত ডলার হয়েছিল এবং মাত্র দুইমাসের মধ্যে সেটা পঁচিশ হাজার ডলার ছাড়িয়ে যায়!
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের দেশের কয়জন মানুষ AI-চ্যাটজিপিটিকে এইভাবে ব্যবহার করার সক্ষমতা রাখে? কিংবা AI-কে নিজের মতো করে নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করার সক্ষমতা রাখে? এক হাজার? দশ হাজার? পঞ্চাশ হাজার? এক লক্ষ? দশ লক্ষ? আরও বেশি? তারপরেও বাকী সবাই কী করবে? গুগলের AI-প্রোগ্রাম “আলফাকোডের” সাথে প্রতিযোগিতা করে আমাদের দেশের কতজন প্রোগ্রামার টিকে থাকতে পারবে? একশত? এক হাজার? পাঁচ হাজার? দশ হাজার? আরও বেশি?
এরপরেও একটা সমস্যা আছে! আমাদের ব্যবস্যাই হোক বা অন্য কিছুই হোক, আমাদের সকল তথ্য কিন্তু AI-চ্যাটজিপিটি কিংবা সার্চ ইঞ্জিনের হাতে থেকেই যাচ্ছে! আমার সমস্যা, সেই সমস্যার সমাধান, আমার পছন্দ, আমার অপছন্দ, আমার কষ্ট, আমার ভালোলাগা, সবকিছুই অন্যের হাতে চলে যাচ্ছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে, মানুষের ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা বা Privacy বলে আর কিছুই থাকবে বলে মনে হয় না!
দুশ্চিন্তার আরও কারণ আছে, কেননা সমস্যার শেষ এখানে নয়। আমার কেন জানি ভয় হয়, জ্ঞান অর্জন বা গবেষণার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যও আজ আর আমাদের হাতে নাই, সবকিছুই সেই শাসক শক্তির নিয়ন্ত্রণে! সেই প্লেটো-সক্রেটিসের যুগের জ্ঞানচর্চা আর আজকের বাণিজ্যিক-রাজনীতির যুগের জ্ঞানচর্চার উদ্দেশ্যের মধ্যে বিস্তর বিস্তর ফারাক রয়েছে। আচ্ছা, আশির দশকে নিউক্লিয়ার বিজ্ঞানীদের সংখ্যার যে আধিক্য ছিল বা দাপট ছিল, আজ কি সেটা আছে? নিউক্লিয়ার সায়েন্সের সবকিছু কী আবিষ্কার হয়ে গিয়েছে? নাকি, আশির দশকে শীতল যুদ্ধের (Cold War) সময়ের মতো নিউক্লিয়ার বিজ্ঞানীদের এখন চাহিদা নাই? তাহলে, নতুন জ্ঞান সৃষ্টির জন্য গবেষণার এই চাহিদা বা লক্ষ্য আসলে কে নিয়ন্ত্রণ করছে? আজকে নবায়নযোগ্য জ্বালানী, ন্যানোটেকনোলজি কিংবা কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এর উপর নতুন নতুন গবেষণার জন্য যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ পাওয়া যায়, গবেষক পাওয়া যায়, শিল্প-কলা-সাহিত্য বা বিজ্ঞানের অবাণিজ্যিক মৌলিক গবেষণার জন্য কি সেই পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ পাওয়া যায় বা গবেষক পাওয়া যায়? সত্যি উত্তর হচ্ছে, পাওয়া যায় না। কিন্তু কেন পাওয়া যায় না? কারণ এই ধরণের গবেষণার “বাণিজ্যিক মূল্য” কম বা আর্থিক মুনাফা নাই! তাহলে নতুন নতুন জ্ঞান সৃষ্টির জন্য গবেষণা আজ কাদের জন্য? মানবজাতির বৃহত্তর কল্যাণের জন্য, নাকি আগ্রাসী শাসক শ্রেণির শক্তির নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধির জন্য? আজকে ইমেজ প্রসেসিং-এর উপরে একটি গবেষণাপত্র IEEE-এর জার্নালে লিখে আমি তৃপ্তির ঢেকুর তুলছি! গবেষণার এই ফলাফল পুরাতন এমআরআই মেশিনে যুক্ত করে, নতুন ভার্সনের একটা এমআরআই মেশিন বাজারে আসবে, ফলে আগে যে এমআরআই একশত টাকায় করা যেত, তখন সেই নতুন মেশিনে এমআরআই করতে একশত বিশ টাকা লাগবে! তাহলে, গবেষণার এইসব ফল আসলে কে ভোগ করছে? শাসক শ্রেণির একটি অংশের “আরও বেশি” মুনাফা আর আরেকটি অংশের “আরও উন্নত” স্বাস্থ্যসেবার জন্য নয় কি? তাহলে নতুন নতুন জ্ঞান সৃষ্টির জন্য, গবেষণার ধারণা ও লক্ষ্য কিংবা “গবেষণায় সাফল্যের তৃপ্তির ঢেকুর” কী আর আজ শাসক শ্রেণির অদৃশ্য ইশারায় নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে না? AI কি শে্য পর্যন্ত সেই শাসক শ্রেণির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে একটা অজানা পৃথিবী তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে না বা হবে না? সেই নতুন পৃথিবীতে, শাসিত শ্রেণির মানুষের মঙ্গলের জন্য, বৈষম্য নিরসনের জন্য, স্বাধীন ভাবে জ্ঞানচর্চা করার সুযোগ কী থাকবে? সেই অজানা নতুন পৃথিবী কি আট বিলিয়ন মানুষের জন্য তৈরি হবে, নাকি সেই পৃথিবীতে “অপ্রয়োজনীয়” বিলিয়ন বিলিয়ন “শারীরিক শক্তি সর্বস্ব” মানুষ অস্তিত্ত্বের সংকটে পড়বে?
কেমন হতে পারে সেই নতুন পৃথিবী! ইতোমধ্যে লক্ষ্য করা গিয়েছে, উন্নত দেশগুলোতে জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার নিম্নমুখী, অনেক দেশে তো জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার এখন ঋণাত্মক। যেমন, ২০২৩ সালে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের একটি রিপোর্ট অনুসারে, ২০২২ সালে জাপান, পোল্যান্ড, ইটালীর জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার যথাক্রমে, -০.৪%, -০.৫% এবং -০.৪%, উন্নত চিকিৎসা সেবার কারণে এইসব দেশে মৃত্যুহার অনেক কম, নতুবা এইসব দেশে জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার আরও বেশি ঋণাত্মক হতো। ফলে ধরে নেওয়া যায়, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের বিকাশের সময়ে, ধীরে ধীরে এবং এক স্বাভাবিক গতিতে এইসব দেশে একসময় অনেকের বংশের বাতি নিভে যাবে অর্থাৎ তাঁরা হারিয়ে যাবেন! অন্যদিকে প্রশ্ন হচ্ছে, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চূড়ান্ত পর্যায়ে, AI-নির্ভর স্বয়ংক্রিয়করণের যুগে, শাসক শ্রেণির নিকটে, তৃতীয় বিশ্বের “শারীরিক শক্তি সর্বস্ব” শাসিত শ্রেণির প্রয়োজন আসলে কতটুকু থাকবে? আর যদি প্রয়োজন না থাকে, তাহলে, এই বিলিয়ন বিলিয়ন “শারীরিক শক্তি সর্বস্ব” শাসিত শ্রেণির অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য, বন্যা-খরা-দুর্যোগ-জরা-মহামারীর সময় খাদ্য-বস্ত্র-ওষুধ কি ঐ শাসক শ্রেণি প্রদান করবে? “মুনাফা-বিনে” এই ধরণের মানবিক আচরণ কী আমরা শাসক শ্রেণির নিকট থেকে আশা করতে পারি?
তাহলে শেষ পর্যন্ত, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চূড়ান্ত ধাপের বিশ্বব্যবস্থা কী শুধুমাত্র শাসক শ্রেণির জন্য নির্মিত হবে? নাকি, সেখানে শাসিত শ্রেণির অস্তিত্বও থাকবে? সেই প্রশ্নের উত্তর আমি জানি না। শুধু বলতে পারি, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের AI-প্রোগ্রামগুলো যতই উন্নত হোক না কেন, মানুষের মতো মানবিকতা-আবেগ-স্নেহ-প্রেম-ভালোবাসা কী আর সেই AI-প্রোগ্রামগুলো অর্জন করতে পারবে? আমাদের মানবিকতা, আবেগ, সহানুভূতি, প্রেম এবং ভালোবাসার অস্তিত্ব আছে বলেই আমাদের সমাজ এখনও টিকে আছে, আমাদের পৃথিবী এখনও টিকে আছে! চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চূড়ান্ত ধাপেও যদি এই সার্বজনীন পৃথিবীর অস্তিত্ব টিকে যায়, তাহলে সেটা আমাদের মানবিকতা, আবেগ, সহানুভূতি, প্রেম এবং ভালোবাসার বিজয়ের কারণেই হবে। আর সেই সার্বজনীন পৃথিবীর অস্তিত্ব যদি না টিকতে পারে, তাহলেও সেটা আমাদের মানবিকতা, আবেগ, সহানুভূতি, প্রেম এবং ভালোবাসার অভাবের কারণেই হবে!
আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে জানতে পড়ুন: আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স: আগামী প্রজন্মের জন্য চ্যালেঞ্জ।[/vc_column_text][/vc_column][/vc_row]